ভারতের ইতিহাসে সম্রাট সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এক বিশিষ্ট নাম,আমরা এই আর্টিকেলে তাঁর জীবনী ও তৎকালীন ভারতবর্ষের সম্বন্ধে জানবো।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও অশোক
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক ছিলেন মৌর্যবংশের নরপতি। এই মৌর্যবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সম্রাট সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন মহান সম্রাট অশোকের পিতা সম্রাট বিন্দুসারের পিতা অর্থাৎ অশোক ছিলেন মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এর শ্রেষ্ঠ গুণগুলি প্রস্ফুটিত অবস্থায় প্রকাশ লাভ করেছিল সম্রাট অশোকের মধ্যে। অশোক কেবল রাজ্যশাসনই করতেন না, প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন প্রজাপালক মহান নরপতি।
প্রজাদের সুখ-দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখরূপে গ্রহণ করে রাজ্যশাসন ও প্রজাপালনের যে অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোন উদাহরণ নেই।
![সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjvHrK8Yrk00CjjF6640-icbMw1dX0CQBy2I7liNHOLKr6-SY3a8TxaGIcTgdbAudgJEMpASBMaEuL-Z1JOhsBFtVfhuJkXQbrNRFX4iJHzAcyNOzGdW4I2QAuWXcXNJMWu1gsWO1Y5Txtx2qAVI1lcP4-gzf-nIOWCJnYF0DvtkLiSE09_a6bpvh3NHw/w640-h336/%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9F_%E0%A6%9A%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%A4_%E0%A6%AE%E0%A7%8C%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF.webp)
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এর জীবন বৃত্তান্ত
জন্ম | 340 খ্রি: পূর্ব( BC) |
জন্মস্থান | পাটলিপুত্র |
মৃত্যু | 279 B |
মৃত্যুর স্থান | শরভানবাবলগলা,কর্ণাটক |
রাজত্ব | 340 BC-279 BC |
পত্নী | দুরধারা, হেলেনা |
সন্তান | বিন্দুসার |
উত্তরসূরি | বিন্দুসার |
পিতা | সর্বভারতীদ্ধি |
মাতা | মুরা |
পৌত্র | অশোক, সুসিমা, বিতাশা |
শিক্ষক/প্রধান মন্ত্রী | চাণক্য |
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রথম জীবন:
চন্দ্রগুপ্তের জীবনের প্রথমাংশ সম্বন্ধে বিশদভাবে কিছু জানা যায় না। তাঁর সম্পর্কে হিন্দু এবং বৌদ্ধ দুটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।
হিন্দু কিংবদন্তি অনুসারে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন মগধের রাজা ধননন্দের শূদ্রাণী পত্নী মুরার পুত্র। মাতার নামানুসারে তিনি তাঁর বংশের নামকরণ করেছিলেন। মৌর্যবংশ।
বৌদ্ধ কিংবদন্তি অনুসারে, চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন ক্ষত্রিয়। হিমালয়ের পাদদেশে পিপ্পলিবন নামক স্থানের মোরিয় ক্ষত্রিয় রাজবংশের সন্তান।
পিতার মৃত্যুর পর যুবা বয়সে রাজনৈতিক কারণে তিনি মাতার সঙ্গে মগধে চলে এসে থাকবেন।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের উত্থান :
সেই সময় মগধে নন্দরাজা রাজত্ব করছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যাচারী বিলাসী ও প্রজাপীড়ক। ফলে রাজ্যজুড়ে প্রজাদের মধ্যে রাজার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল ধূমায়িত। উচ্চাভিলাষী চন্দ্রগুপ্ত এই সুযোগ গ্রহণ করে মগধের সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। অবশ্য এই কাজে তাঁর সহায় ও সাহায্যকারী ছিলেন কূটবুদ্ধিব্রাহ্মণ চাণক্য।
বৌদ্ধমতে, চন্দ্রগুপ্তের মোরিয় বংশ থেকেই তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের নাম হয়েছিল মৌর্যবংশ। হিন্দু এবং বৌদ্ধ এই দুই মতে চন্দ্রগুপ্ত সম্পর্কে এইটুকুই যা পার্থক্য। পরবর্তী ইতিহাস নিয়ে আর কোনও দ্বিমত নেই।
দিগ্বিজয়ী গ্রীকবীর আলেকজান্ডার পুরুর রাজ্য পাঞ্জাব অধিকার করার পর ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে ইতস্ততঃ করছিলেন। মহারাজ পুরুর বীরত্ব তাঁকে কেবল মুগ্ধই করেনি তাঁর মনের গভীরে ভীতিরও সঞ্চার করেছিল। এরকম আর কিছু বীরের সঙ্গে যদি তাঁকে শক্তিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় তাহলে যে রণক্লান্ত গ্রীক বাহিনীকে পর্যদস্ত হতে হবে এ সম্পর্কে তার কোনও সন্দেহ ছিল না। এছাড়া আরো কিছু কারণেও তাঁর সৈন্যরা ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সাহস পাচ্ছিল না।
মগধরাজ ধননন্দের বিপুল সামরিক ক্ষমতার সংবাদ তাদের অজানা ছিল না। তাই দীর্ঘ অভিযানের ক্লান্তি কিঞ্চিৎ অধিক মাত্রায়ই তাদের অনুভূত হচ্ছিল। ফলে দেশে ফিরে যাবার জন্য তারা চঞ্চল হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু ভারতবর্ষের বিপুল ধনসম্পদের সন্ধান জানতেন আলেকজান্ডার। তাই ভারতবর্ষের দুয়ারে পৌঁছেও ফিরে যেতে রাজি ছিলেন না তিনি। নানাভাবে বুঝিয়ে সৈন্যদের স্বমতে আনার চেষ্টা করতে লাগলেন। ঠিক এই সময়ে মগধরাজ ধননন্দের বিরুদ্ধে প্রজাদের ক্ষোভ ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। নন্দরাজের উচ্ছেদই ছিল তাদের কাম্য। উচ্চকাঙ্ক্ষী বীর যুবক সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এই সুযোগটিকেই কাজে লাগাতে চাইলেন। তিনি সাহায্যের প্রয়োজনে এবং যুদ্ধবিদ্যার বিভিন্ন কলাকৌশল আয়ত্ত করবার উদ্দেশ্যে গ্রীকবীর আলেকজান্ডারের শিবিরে উপস্থিত হলেন।
সাহায্যপ্রার্থী চন্দ্রগুপ্তের নির্ভীক ও উদ্ধত আচরণে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না ম্যাসিডনীয় বীর আলেকজান্ডার। তিনি এই বিদেশী যুবককে বন্দী করে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করলেন।
কিন্তু, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন বীর ও বুদ্ধিমান। অচিরেই গ্রীক শিবির থেকে তিনি পালিয়ে আত্মরক্ষা করলেন। চন্দ্রগুপ্তের জীবনের এই ঘটনা ভারতের ইতিহাসে শুভ পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও চাণক্যে :
মহামতি চাণক্য ছিলেন কূটবুদ্ধিসম্পন্ন বিচক্ষণ ব্রাহ্মণ। তাঁর সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের শক্তির মিলন ঘটায় ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক মহৎ রাজবংশের অভ্যুদয় সম্ভব হয়ে ওঠে।
গ্রীক শিবির থেকে পালিয়ে আসার পর দৈবক্রমেই চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে পরিচয় হয় চাণক্যের। তক্ষশিলার এই বিচক্ষণ ব্রাহ্মণ কূটনীতি ও রাজনীতিতে ছিলেন অভিজ্ঞ ও বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন।
নন্দবংশের প্রতি তিনি ছিলেন রুষ্ট। এর পেছনের ইতিহাস সোমদেবের ‘বৃহৎকথা’ থেকে জানা যায়। নন্দরাজার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সনাতন। কোনও কারণে নন্দরাজা সনাতনের ওপর বিরক্ত হয়ে তাঁকে সপরিবারে বন্দী করেন।
সনাতনের স্থান হয় একটি বদ্ধ ঘরে। সেখান থেকে কোনওক্রমে তিনি একাকী পালিয়ে যেতে সমর্থ হন।
ঘটনাচক্রে এই সময় চাণক্যের সঙ্গে সনাতনের পরিচয় হয় এবং তিনি উপলব্ধি করতে পারেন চাণক্যের মতো বিচক্ষণ ব্যক্তিই পারেন তাঁকে রাজরোষ থেকে উদ্ধার করতে।
তাঁর অনুরোধে চাণক্য রাজপ্রাসাদের একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। কিন্তু সেখানে তিনি চরমভাবে অপমানিত হন। রাজসভার মধ্যে নন্দরাজ। তাঁকে মাথার শিখা টেনে বিতাড়িত করেন।
এই অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য সেই মুহূর্তেই চাণক্য নন্দবংশ ধ্বংসের শপথ নেন।
কিন্তু বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় সমৃদ্ধ হলেও চাণক্য ছিলেন শক্তিহীন। তাই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তিনি শক্তিমান মাধ্যমের অন্বেষণ করতে থাকেন।
সেই সন্ধিক্ষণেই গ্রীকশিবির থেকে পলাতক চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। উভয়ের এই যোগাযোগ যেন ছিল দৈব নির্দিষ্ট। কেন না এই সম্মিলনের ফল তৎকালীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূত্রপাত করেছিল। পরিণামে বৃহৎ ভারতবর্ষ জুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কল্যাণরাষ্ট্র।
মৌর্য সাম্রাজ্য :
চন্দ্রগুপ্ত যে মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারই তৃতীয় পুরুষ ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক। তিনি ছিলেন চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন বীর এবং উচ্চাভিলাষী। ব্রাহ্মণ চাণক্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটার পর তিনি উৎসাহিত হন এবং নন্দরাজের সিংহাসন অধিকারের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন।
চাণক্যের কাছ থেকে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এই সময় লাভ করলেন রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রশিক্ষণ। তক্ষশিলার সুযোগ্য ছাত্র হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন বিদ্যায় তাঁর বুৎপত্তি ছিল। সেই শিক্ষার বলে তিনি অনুগত চন্দ্রগুপ্তকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করে তুলতে লাগলেন।
চাণক্যের পরামর্শে চন্দ্রগুপ্ত পাহাড়ি উপজাতিদের সঙ্ঘবদ্ধ করে অবিলম্বে এক শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তুললেন। তারপর সেই বিপুল বাহিনী নিয়ে একদিন আক্রমণ করলেন মগধের রাজধানী পাটলিপুত্র। উভয়পক্ষ লিপ্ত হয় ভয়ঙ্কর যুদ্ধে। নন্দরাজ ধননন্দ যুদ্ধে পরাজিত হন এবং চন্দ্রগুপ্ত অধিকার করেন মগধের সিংহাসন।
বহুযুগ আগে থেকেই সমগ্র ভারতবর্ষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। বৈদিক যুগ থেকেই আর্যরা এই ক্ষুদ্র রাজাগুলির মধ্যে রাষ্ট্রীয় ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এই প্রচেষ্টা সর্বার্থে সার্থকতা লাভ করতে পারেনি।
মগধের সিংহাসনের অধিকার লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই চন্দ্রগুপ্ত এই বিষয়ে উদ্যোগী হলেন। প্রথমেই তিনি নজর দিলেন ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে। সেই অঞ্চল দখল করে ছিল আলেকজান্ডারের গ্রীক বাহিনী।
ইতিমধ্যে আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয়েছে এবং ভারতে তাঁর অধিকৃত অঞ্চলে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল।চন্দ্রগুপ্ত গ্রীকরাজনীতির গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য করছিলেন। গ্রীক অধিকৃত অঞ্চল যত অশান্ত হয়ে পড়ছিল ততই তিনি আশান্বিত হয়ে উঠছিলেন।
গ্রীক অঞ্চলে প্রজা বিদ্রোহে গ্রীক শাসক নিহত হলেন। এই সুযোগে চন্দ্রগুপ্ত গ্রীক অঞ্চল আক্রমণ করলেন এবং গ্রীক বাহিনীকে পরাস্ত করে সেখানে মৌর্যশাসন বিস্তার করলেন। এরপর চন্দ্রগুপ্তের মৌর্যবাহিনী দাক্ষিণাত্যের মহীশূর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূখন্ড অধিকার করে নেয়।
চন্দ্রগুপ্ত ও সেলুকাসের মিত্রতা :
আলেকজান্ডারের পর ব্যাবিলনের অধিকার লাভ করেছিলেন তাঁর প্রাক্তন সেনাপতি সেলুকাস। তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতে গ্রীক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন।
মৌর্য ও গ্রীক উভয় বাহিনী মুখোমুখি যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং শেষ পর্যন্ত সেলুকাস পরাজিত হয়ে সন্ধি করতে বাধ্য হন। সন্ধির শর্ত অনুযায়ী তিনি কাবুল, কান্দাহার, হিরাট ও মাকরান প্রদেশ চন্দ্রগুপ্তকে প্রদান করলেন এবং নিজ কন্যাকে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে বিবাহ দেন।
চন্দ্রগুপ্তও মিত্রতার নিদর্শন স্বরূপ পাঁচশত হস্তী সেলুকাসকে উপহার দেন। পরবর্তীকালে সেলুকাস মেগাস্থিনিস নামে এক গ্রীক দূতকে পাটলিপুত্রের রাজসভায় পাঠিয়েছিলেন।
সেলুকাসের সঙ্গে সন্ধি ও বৈবাহিক সম্বন্ধ হবার ফলে গ্রীক ও হিন্দ—এই দুই প্রাচীন সুসভ্য জাতি পরস্পরের সান্নিধ্য লাভ করেছিল। ফলে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদান প্রদান সম্ভব হয়েছিল। পর্যটক ও বিদ্যানুরাগীদের যাতায়াতের ফলে গ্রীক ও ভারতের মধ্যে যে ঐতিহ্যগত ঐক্য স্থাপিত হল তার ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।
দুই সুসভ্য জাতির শিল্প, সাহিত্য, জ্যোতিষ ইত্যাদি জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আদান প্রদানের ফলে উভয় জাতিই যথেষ্ট উপকৃত হয়েছে। ভারতের ইতিহাসে চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল তাই বিশেষ গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় বলে স্বীকৃত হয়েছে।
প্রাচীন ভারতের ত্যাগব্রতী নরপতিগণের ঐতিহ্যধারারই সার্থক উত্তরসূরী ছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত। ঐশ্বর্য ভোগ ও রাজ্যশাসন অপেক্ষা রাজ্যের নিরাপত্তা,বিধান, রাজ্য ও প্রজাপালনই ছিল তাঁর জীবনের আদর্শ। আর ভারতীয় জীবন ধারার এই সুমহান আদর্শই চন্দ্রগুপ্তের সুশৃঙ্খল রাজত্ব ও অসামান্য সাফল্যের ইতিহাস রচনা করেছিল।
মেগাস্থিনিসের কথায় :
মেগাস্থিনিস কিছুকাল ভারতবর্ষে অবস্থান করেছিলেন। সমসাময়িক ভারতবর্ষ সম্পর্কে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাঁর লেখা থেকে প্রাচীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার বিষয়ে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
মগধের রাজধানী পাটলিপুত্র সম্পর্কে মেগাস্থিনিস বলেছেন, এই নগর ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী। প্রাকারবেষ্টিত নগরীর দৈর্ঘ্য ছিল দশ মাইল আর প্রস্থ ছিল দু মাইল। প্রাকারের ওপরে ছিল ৫৭২টি গম্বুজ এবং চতুষ্পার্শ্বে তোরণ ছিল ৬৪টি। আপন শৌর্য ও বীর্য বলে চন্দ্রগুপ্ত ভারতবর্ষে এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেছিলেন। তিনি ছিলেন সুদক্ষ যোদ্ধা ও সুশাসক।
প্রজাদের সুখ-সুবিধার প্রতি চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন সর্বদা সজাগ। প্রজা প্রতিপালনই ছিল তাঁর আদর্শ। সাম্রাজ্যরক্ষার সর্বক্ষেত্রেই আদর্শ নরপতি হিসেবে তিনি মহত্ত্বও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রাচীন ভারতে চন্দ্রগুপ্তের মতো এতবড় সাম্রাজ্য ইতিপূর্বে কেউ গঠন করতে পারেননি।
চাণক্যের অবদান :
চন্দ্রগুপ্তের সমস্ত সাফল্যের মূলে ছিল চাণক্যের কূটনীতি ও বিচক্ষণতা। তাঁর সফল কূটনীতি রক্ষাকবচের মতো সর্বক্ষেত্রে রক্ষা করেছে চন্দ্রগুপ্তকে।
চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাক্ষস। তিনি নানাভাবেই চন্দ্রগুপ্তের ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করেছিলেন। তার সমস্ত কূটকৌশল ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন চাণক্য ।
চন্দ্রগুপ্তের বিরুদ্ধে রাক্ষস যেসব গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেন এবং নিজের গোপন উদ্দেশ্য অকপটে তাদের কাছে প্রকাশ করেছিলেন পরে প্রমাণ হয়ে যায়। তারা সকলেই ছিল চাণক্যের গুপ্তচর।
আশাহত ক্ষুব্ধ রাক্ষসকে শেষ পর্যন্ত এই বলে খেদোক্তি করতে হয়—শত্রু আমার অন্তঃপুর পর্যন্ত অধিকার করেছে।
ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসী চাণক্য ছিলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। অসাধারণ কূটনৈতিক বিচক্ষণতার বলে তিনি মৌর্য সাম্রাজ্য ও সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকে নিরাপত্তা দিয়েছিলেন।
চন্দ্রগুপ্ত ও জৈন ধর্ম :
হিন্দু ধর্মাবলম্বী চন্দ্রগুপ্ত জীবনের শেষদিকে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি জৈনগুরু ভদ্রবাহুর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। জৈন ধর্মের অহিংসার ব্রত সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কে আকৃষ্ট করেছিল।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে জৈনগুরু ভদ্রবাহু ছিলেন বঙ্গসন্তান। তৎকালীন বঙ্গদেশের পৌণ্ড্রবর্ধন অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন তিনি। বর্তমান মালদহেরই প্রাচীন নাম ছিল পৌণ্ড্রবর্ধন।
একদিন রাজসভার দৈবজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, রাজ্যের অমঙ্গল আসন্ন। তাঁরা সম্রাটকে জানালেন, উত্তর ভারত অবিলম্বে দুর্ভিক্ষের কবলিত হবে এবং এই সঙ্কটকালের বিস্তৃতি বারো বছর। প্রকৃতির এই রোয কোনভাবেই নিবারণ করা সম্ভব হবে না।
দৈবজ্ঞদের এই বক্তব্য শুনে স্বভাবতঃই প্রজানুরঞ্জক চন্দ্রগুপ্ত বিচলিত হলেন। আসন্ন দুর্ভিক্ষের কবল থেকে প্রজাদের রক্ষা করার উপায় তিনি চিন্তা করতে লাগলেন ।
যথাসময়ে দৈবজ্ঞদের গণনাকে নির্ভুল প্রমাণ করে রাজ্যে দেখা দিল নিদারুণ খরা ও অজন্মা । সামান্য ফসল যা উৎপন্ন হল তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। ব্যাপক এলাকার জনগণের অনটন মোকাবেলা করার মতো কোন পথ ছিল না। এই অজন্মা চলল বছরের পর বছর। ফলে রাজভান্ডার হলো নিঃশেষিত। মানসিকভাবে পীড়িত চন্দ্রগুপ্ত পর্যাপ্ত ফসল উৎপাদনের জন্য উর্বর জমির সন্ধান করতে লাগলেন।
শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর রাজ্যের মহীশূর অঞ্চলকেই অসহায় প্রজাদের পুনর্বাসনের জন্য নির্দিষ্ট করলেন। ঠিক এই সময়েই রাজগুরু ভদ্রবাছ পরলোক গমন করলেন। গুরুর আকস্মিক মৃত্যুতে চন্দ্রগুপ্ত মর্মাহত হলেন।
প্রজাদের অসহায়তার জন্য মানসিকভাবে পীড়িত বোধ করছিলেন তিনি। এবারে হয়ে পড়লেন অসহায়। এই অবস্থায় মানসিক স্থৈর্যরক্ষা করা তাঁর পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল।
ফলে ক্রমেই রাজকার্যের প্রতি আকর্ষণ হারাতে লাগলেন তিনি। প্রজাদের দুঃখে এই সময় এতটাই কাতর হয়ে পড়েছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যে আহার গ্রহণ করতেও কুণ্ঠাবোধ করতেন।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শেষজীবন :
জীবের দুঃখে হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছিল সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের। তাই একদিনেই তিনি সমস্ত ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি পরিত্যাগ করে ভিক্ষু সন্ন্যাসীর ব্রত গ্রহণ করেছিলেন এবং প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করেছিলেন। চন্দ্রগুপ্তের জীবনচর্যা ও তাঁর সাম্রাজ্য পরিচালনা জগতবাসীর দৃষ্টান্তস্থল হয়ে আছে।
শেষ জীবনকালে দাক্ষিণাত্যে নর্মদা নদীর তীরে শ্রবণ বেলগোলা নামক স্থানে অনশন ব্রত আরম্ভ করলেন এবং এইভাবেই ছেদ পড়ল তাঁর জীবনের। মৃত্যুকালে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের বয়স ছিল ষাট বছর।
উপসংহার :
মৌর্যসম্রাট সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য উত্তরপুরুষ সম্রাট অশোক উত্তরধিকার সূত্রেই লাভ করেছিলেন তাঁর পিতামহের অহিংসাবৃত্তি, লোকহিতৈষণা ও প্রজাবাৎসল্য। এই দুর্লভ গুণাবলী তাকে পৃথিবীর দুর্লভ গৌরবের অধিকারী করেছিল।
নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি ফলো করো!